Tip:
Highlight text to annotate it
X
আমি, খেলার মাঠে জীবনে প্রথমবারের মত পরিচয় সংকটের মুখোমুখি হয়েছিলাম।
মনে পড়ে, আমার সহপাঠীরা আমার কাছে এসে বলছিল,
"সামির, তুমি কোন ধর্মের? তুমি কি খ্রিস্টান নাকি ইহুদী? "
এবং, মনে আছে, এই প্রশ্নে আমি খুব বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম।
আমি তখন কেবলই বাংলাদেশ থেকে এসেছি,
আমি যুক্তরাষ্ট্রে থাকতাম -
এবং মনে আছে আমি ভাবছিলাম,
আমি নির্ঘাত খ্রিস্টান নই কারণ আমি বড়দিনে কোনও উপহার পাই না,
তাই, যদি আমার হাতে শুধুমাত্র এই দুটো বিকল্পই থাকে, তাহলে আমি নিশ্চয়ই ইহুদী।
তাই আমি ওদের দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম, "জন, আমি ইহুদী।"
এবং এটা এরকমই ছিল, এবং আমি নিজেকে ইহুদী মনে করেই কয়েক মাস কাটিয়ে দিলাম
- মনে রাখবেন, তখন আমার বয়স মাত্র আট বছর।
হানুকা সমাগত না হওয়া পর্যন্ত এভাবেই চলছিল
এবং হানুকা উপলক্ষেও আমি কোনও উপহার পেলাম না
আত্মপরিচয় একটি বিরাট ব্যাপার - এটাই আমার বক্তব্য।
আত্মপরিচয় শুধুমাত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারই নয়,
এটি হওয়া উচিত আপনার গল্প,
এবং যা আপনার চূড়ান্ত আশা-আকাঙ্খার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
তাই, দু'বছর আগে আমি যখন বাংলাদেশে ফিরে এলাম,
আমি এমন একটি আত্মপরিচয় খুঁজছিলাম যার হাত ধরে অর্থবহ ভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে -
এই দেশের সাথে আমার সম্পর্কের।
আমি আমার সত্যিকার আগ্রহের কাজগুলো শুরু করলামঃ
আলোকচিত্র, ভ্রমন, লেখালেখি -
এবং আমি একটি সাধারন সূত্র খুঁজে পাওয়া শুরু করলাম।
আমি এদেশের বৈচিত্রের বিশালত্বকে আবিস্কার করতে শুরু করলাম
- শুধু তাই নয়, এই বৈচিত্রের মাঝেই নিহিত আছে
কোন জিনিসটি বাংলাকে এত সফল একটি সভ্যতা বানিয়েছে - এই প্রশ্নের উত্তর।
এখানে আমি গর্ব করার মত একটি আত্মপরিচয়ের সন্ধান পাই,
এবং এটি ছিল সম্ভাবনাময় একটি আত্মপরিচয়।
তাই, দীর্ঘ অপেক্ষার পরে, গত বছর আমি তিব্বত ভ্রমনে যাই।
এবং আমার বিমান বন্দরে যখন আমার বৌদ্ধ ট্যুর গাইডের সাথে দেখা হল,
একজন বাংলাদেশীর সাক্ষাৎ পেয়ে তিনি ছিলেন যরপরনাই উদ্বেলিত।
তিনি বারবার "বাংলাদেশী! বাংলাদেশী!" বলে চিৎকার করছিলেন
এবং তখন আমি এটা বুঝতে পারিনি,
কিন্তু প্রতীয়মান হল যে, এক হাজার বছর আগে
তখনকার তিব্বতের রাজা এক বাঙালী সন্ন্যাসীর এতটাই ভক্ত হয়ে পড়েছিলেন
যে তিনি বাংলায় তাঁর প্রতিনিধি পাঠান
সেই সন্ন্যাসীকে তিব্বত ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানাতে
যেন তিনি সেখানে বৌদ্ধ ধর্মের চর্চা পুনরুজ্জীবিত করতে সহায়তা করেন,
বহু বছরের অবক্ষয় ও অবদমনের পরে।
এটি ছিল একটি অসাধারণ কর্মযজ্ঞ।
এবং সেই বাঙালি সাধু কাজটি হাতে নিয়েছিলেন,
তাঁর কাজ এতটাই আলোড়ন সৃষ্টিকারী এবং এতটাই ফলপ্রসূ হয়েছিল,
যে আজকের বৌদ্ধরা, এবং সারা তিব্বতের তিব্বতিরা
তাঁকে অতীশ অর্থাৎ পরম প্রভু হিসাবে গন্য করে,
স্বয়ং বুদ্ধ ছাড়া তাঁর চেয়ে উঁচুতে কারো স্থান নেই।
এবং তিব্বতের যেখানেই আমি গিয়েছি,
যতগুলো মঠে গিয়েছি,
আমরা অতীশের মূর্তি দেখেছি, একজন বাঙালী, বুদ্ধের ঠিক পাশেই তাঁর অবস্থান।
প্রকৃতপক্ষে, আপনি মঙ্গোলিয়া কিম্বা জাপানে যান -
এমনকি অস্ট্রেলিয়া বা বিশ্বের যে কোনও বৌদ্ধ অধ্যুষিত এলাকায়
আজও আপনি কেন্দ্র, মঠ এবং মূর্তি দেখতে পাবেন
অতীশের উদ্দেশ্যে নিবেদিত - এমনি সুগভীর প্রভাব ছিল তাঁর।
এখন, আজ এখানে উপস্থিত কতজন এই বিষয়টা সম্পর্কে শুনেছেন?
এবং আজ এখানে উপস্থিত কতজন জানেন এই অতীশ কোথা হতে এসেছিলেন?
তিনি ঠিক এই স্থান থেকে এসেছিলেন, ঢাকা থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূর থেকে।
এবং আপনি আমার মত আগ্রহী হন,
কোন ধরনের সমাজে এই রকম একজন মানুষের জন্ম হতে পারে?
বেশ, এক হাজার বছর আগে বাংলা ছিল একটি আন্তর্জাতিক ক্ষমতার অন্যতম মধ্যমনি।
বাংলা সাম্রাজ্যের সীমানা এমন কি সুদূর পশ্চিম আফগানিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল,
সে ছিল ভারত মহাসাগর অঞ্চলের বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রক।
এবং তাঁরা পাহাড়পুরের এটার মত মঠ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ প্রতিষ্ঠা করেছিল।
দেশ বিদেশের বিদ্বান পণ্ডিতগণ এখানে আসতেন
এই গৌরবান্বিত বিদ্যায়তনে অধ্যয়নের আশা নিয়ে।
এবং তখনকার দিনে দেখতে ঠিক এরকমটি ছিল - এটি অবশ্য একটি ত্রিমাত্রিক পরিস্ফুটন মাত্র।
সেখানে ধর্ম সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলী নিয়ে কাজ হত
- সে আপনি যে ধর্মের সাথেই সংযুক্ত হন না কেন,
আপনি সেখানে স্বাগত ছিলেন।
এবং আজ পর্যন্ত এটি সবচেয়ে বড়গুলির অন্যতম।
এবং এটি যদি দেখতে আর দশটা মঠের মত মনে হয়
যেগুলো আপনি দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার নানাস্থানে দেখেছেন,
জানবেন, এটিকে মডেল ধরেই অন্যান্য মঠগুলি তৈরি হয়েছিল।
এবং এটি ঠিক এখানেই - বাংলাদেশে।
দেখুন, আমরা যদি জাতি-রাষ্ট্রের আঙ্গিকে আত্মপরিচয় নিয়ে ভাবি,
তাহলে ১৯৭১ কে পর্যাপ্ত গুরুত্ব না দেবার কোনও উপায় নেই।
এবং এটা করতে গিয়ে আমরা আরও অনেক বড় একটি আখ্যানকে উপেক্ষা করার ঝুঁকিতে পরে যাই -
যেটি কিনা বাঙালী সত্ত্বাকে সংজ্ঞায়িত করে।
দেখুন, ১৯৭১ যদিও ব্যাখ্যা করে যে, কেন আমরা আমাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রের পক্ষে লড়েছিলাম,
কিন্তু আমাদের সংস্কৃতি এবং আত্মপরিচয়ের উৎস সম্পর্কে কোনও ব্যাখ্যা সেখানে নেই।
এবং এই উৎসটা জানা বেশ জরুরি কারণ এর মাধ্যমে আমরা সেই গুরুত্বপূর্ণ ধারণাটি পাই -
প্রথমেই কিভাবে আমরা সুসভ্যতার একটা শক্তিতে পরিণত হয়েছিলাম।
দেখুন, বিশ্বাস করুন আর নাই করুন,
এককালে বাংলাকে সবাই জানতো তার বিশ্বব্যাপী গৌরবের জন্য,
তার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য,
এবং তার সুললিত মেধাচর্চার জন্য।
আর তাই আমরা একটি ধারা গড়ে উঠতে দেখতে পাচ্ছি -
যে একটি দল-মত নির্বিশেষে সবার জন্য উন্মুক্ত, সার্বজনীন সমাজের প্রয়োজন হয়
নিরাপত্তা, স্থায়ীত্ব এবং সম্পদ উৎপাদন নিশ্চিত করার ভিত্তি তৈরির জন্য,
যা আমরা বাংলার ক্ষেত্রে দেখেছি।
এবং বাংলার প্রাচীন শাসকগণ
মনে হয় সাফল্যের এই গুপ্তরহস্যটা ধরতে পেরেছিলেন।
তাই বাংলাকে দেখতে পাই একটি বিশাল বৈচিত্রমণ্ডিত এক জনপদ হিসেবে
এবং তার শাসক ও সমাজপতিগন এই বিশাল বৈচিত্রকে চালিত করছেন
সেই দিকে, যেখানে আছে উৎপাদনশীলতা, মুক্তচিন্তা,
সার্বজনীনতা এবং দল-মত নিরপেক্ষতা।
তাই, যদি জানতে চান,
বাংলার এই বিশাল বৈচিত্র্য কোথা হতে এল-
আমি মানচিত্রের বড় ভক্ত এবং এর সাহায্যে অনেক কিছু ব্যাখ্যা করা যায়।
তাই, এটি দেখুন
এবং হিমালয় থেকে নেমে আসা এই নদীগুলো খেয়াল করুন,
কিভাবে তারা সবাই এই বঙ্গীয় ব-দ্বীপে নেমে এসেছে-
নিঃসন্দেহে এই নদীগুলিই ছিল প্রাচীনকালের যোগাযোগের মহাসড়ক-ব্যবস্থা।
হুম, এই ম্যাপটিকে বেশ পরিষ্কার মনে হচ্ছে -
দেখুন, চীন, ভারত, ভূটান, নেপাল... পুরো দক্ষিণ এশিয়া থেকে
এই সব বড় বড় নদী সোজা এসে বাংলাতে ঢুকেছে।
ফলে দেখা যাচ্ছে যে, সেই আদিকাল থেকেই মানুষের পদচারণায় বাংলা ছিল মুখরিত,
ছিল নানান সংস্কৃতির ও নানান জাতিগোষ্ঠীর পদচারণায় মুখর।
কিভাবে আপনি এহেন ঐকতান তৈরি করবেন?
বহুত্ব এমনি এমনি হয়ে যায় না।
শুধু বৈচিত্র্য থাকলেই সেটি স্বর্গরাজ্য হয়ে যায় না।
বহুত্ব পেতে হলে এমন একটি পরিকল্পিত কর্মপন্থা দরকার যা এই বৈচিত্র্য কে ব্যবহার করতে পারে,
এবং এই বৈচিত্র্যকে সামাজিক প্রগতিশীলতায় পরিণত করতে পারে।
এটি একটি সক্রিয় প্রয়াস।
তাই, উদাহরণস্বরূপ দেখি, সেই মৌর্য যুগে,
২৩০০ বছর আগে, সম্রাট অশোক
- আপনারা অনেকে নিশ্চয়ই তাঁকে জানেন,
তাঁর ঘাড়ে পরেছিল এক পর্বত সমান দায়িত্ব,
৫ কোটি মানুষের শাসনভার,
আজকের বাংলাদেশের সীমানাও যার অন্তর্ভুক্ত ছিল --
কিভাবে তিনি এমনটি করেছেন?
তিনি ইতিহাসের অন্যতম অভূতপূর্ব নিদর্শনে পরি্ণত হলেন
যেখানে রাষ্ট্রের মূলমন্ত্র বহত্ববাদ,
যখন শিলাস্তম্ভ গুলোতে এইসব প্রগাঢ় জ্ঞানগর্ভ বাণীসমূহ লিপিবদ্ধ করিয়েছিলেন
এবং সেগুলো স্থাপন করেছিলেন সাম্রাজ্যের আনাচে কানাচে।
"অপরের মত ও বিশ্বাসকে অবশ্যই সম্মান করতে হবে
যে দিক থেকেই তার কারণ বিবেচনা করি না কেন,
অন্যের বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করার মাধ্যমেই নিজের বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করা হয়
এবং পাশাপাশি অন্যের বিশ্বাসকে সেবা করাও হয় -
তাই ঐক্যতান মাত্রেই প্রশংসনীয়।
এবং তাঁর এই অনুপ্রানিত দূরদৃষ্টির জন্য অশোক পেয়েছেন সীমাহীন সাধুবাদ।
অতীব প্রজাবৎসল ও মহান রাজা মহারাজাদের একজন হিসাবে তিনি শুধু দক্ষিণ এশিয়ার নন,
বরং গ্রীক এবং রোমানরাও তাঁর সময়ের বাংলা নিয়ে লিখে গেছেন,
তাঁরা আমাদের সুসমৃদ্ধ বন্দরগুলো নিয়ে লিখেছেন,
তাঁরা সেখানকার পণ্য সামগ্রীর উৎকর্ষের কথা লিখেছেন,
তাঁরা আমাদের নিখুঁত মানের মুক্তা ও মসলিনের কথা লিখেছেন,
শুধু তাই নয়, সম্প্রতি ঢাকার বাইরেই
একটি ৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের মুদ্রা পাওয়া গেছে - ঠিক এই সময়কালেরই।
এবং এটির উৎস ছিল গ্রীস।
তাই, সেই আদি বিশ্বজনীনতার ধারণাটি পাই
এই বহুত্ববাদী প্রথার ফলস্বরূপ যার উত্থান এই বাংলায়।
আরও দেখি সেই একই ধরনের বহুতাত্বিক মতাদর্শ
বিরজমান বাংলার বুকে, যুগে যুগে, বিভিন্ন শাসকদের আমল জুড়ে।
কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে এক ভয়ঙ্কর গূঢ়তত্ত্বের উত্থান শুরু হল।
আর এই ভয়ঙ্কর গূঢ়তত্ত্বটি ছিল যেহেতু দক্ষিন এশিয়ার বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়সমূহ
কোন না কোন ভাবে বিভিন্ন সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত,
এবং মোহাম্মাদ জিন্নাহ এটি সবচেয়ে সুচারুরূপে তুলে ধরেছিলেন
সেই দ্বিজাতি তত্ত্বে, তিনি বলেছিলেন, মূলতঃ
মুসলমান এবং হিন্দু দুটি আলাদা সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত,
- তাঁদের ধর্ম আলাদা, তাঁদের গ্রন্থ-কিতাবও আলাদা,
তাঁদের ইতিহাস আলাদা,
এবং তাঁদেরকে যদি জোর করে একসাথে রাখা হয়
তাহলে সর্বনাশের মধ্য দিয়েই সেই পরীক্ষা শেষ হবে।
ফলস্বরূপ, দক্ষিণ এশিয়া আজ বিশ্বের চরমতম ধর্মীয় মেরুকরণকৃত, বহুধাবিভক্ত,
এবং পারমাণবিক অস্ত্র সমৃদ্ধ ভূখণ্ড।
দেখুন, সেই দ্বিজাতি তত্ত্ব আমাদের সীমান্ত নিরূপণ শুরু করল,
রাজনীতির ধরন নিরূপণ শুরু করল,
এবং ফলশ্রুতিতে আমরা এর যন্ত্রণা ভোগ করে চলেছি,
দুই দিক দিয়েই, তা সে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেই হোক,
কিংবা আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেই হোক।
বাংলাদেশে, আমরা একটি ধর্ম নিরপেক্ষ শাসনতন্ত্রের আশায় লড়াই করাছি,
যা ছিল আমাদের এই বহুমাত্রিক সমাজ কাঠামোর প্রতিচ্ছবি।
সর্বোপরি, আমরা বিভিন্ন ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা একটি সমাজ।
কিন্তু তারপর, এক প্রজন্ম পার না হতেই, এই প্রশ্নে আমরা উল্টো পথে হাঁটা ধরলাম
এবং এখন আমাদের একটি রাষ্ট্র-ধর্ম হয়েছে
এবং সেই থেকে এটি এরকমই আছে।
এবং যখন এই রাষ্ট্রধর্ম দ্বারা সংখ্যাগুরুদের অনুভুতির প্রতিফলন হয়,
এহেন সংকীর্ণভাবে সনাক্তকরণের ফলে যা হয়
তা হল শুধুমাত্র চরমপন্থীদের ক্ষমতায়ন - সংখ্যাগুরুদের নয়।
তাই এখন দেখা যাচ্ছে, উদাহরণস্বরূপ, গোষ্ঠীসমূহ যারা নির্ধারণ করে দেয়
কোন বইটি পবিত্র আর কোনটি অপবিত্র, কোনটি নিষিদ্ধ হবে আর কোনটি চলবে।
এবং আমরা ইতিমধ্যেই বই নিষিদ্ধ করার নজির দেখতে পেয়েছি।
উদাহরনস্বরূপ দেখেছি, গোষ্ঠীসমূহ যারা নির্ধারণ করেছে যে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা
মানেও অপবিত্রতা, অতএব - বোমা মারো!
এবং এই সকল উৎসব উদযাপনের সময়ে ঘটে যাওয়া হিংসাত্মক ঘটনাসমূহ আমরা দেখেছি।
আমরা সংখ্যালঘুদের জমি জবর দখল করাও দেখেছি, একইভাবে -
ধর্ম ভিত্তিক দিকনির্দেশনার প্রশ্রয়ে এবং দুর্বল রাজনৈতিক পরিভাষার আশ্রয়ে।
ঐতিহাসিক ভাবে, এহেন সংকীর্ণভাবে চিহ্নিতকরণের প্রথাটা বাংলায় কখনও ছিল না,
বাস্তবিক পক্ষে, বাংলা একটি মুসলিম সংখ্যাগুরুতে রুপান্তরিত হয়েছিল
ধর্ম নিরপেক্ষ মুঘল সম্রাটদের ছত্রছায়ায় -
কে কোন ধর্মের অন্তর্গত তা নিয়ে যাঁদের কোনও মাথা ব্যাথা ছিল না।
তাই দেখি বাংলার সুলতানী আমলে,
যখন বাংলা ছিল মুসলমান শাসকদের অধীনে,
কবিগণ লিখে গেছেন, যেমন, ষোড়শ শতকে
কিভাবে ঘরে ঘরে মহাভারত রাখতো,
কিভাবে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সবাই এটি পড়ত।
একই শতাব্দির অনেক গুরত্বপূর্ণ কাহিনী শুনতে পাই অন্য এক কবির লেখায়,
যিনি মুসলিমদেরকে কান্না করতে দেখার কথা বলেছেন
যখন তাঁরা রামায়ন পাঠের মাঝে রাম ও সীতার বিচ্ছেদ কাহিনী শোনে।
এই বাঙালী সুলতানগণ ছিলেন হিন্দু কর্মকাণ্ডেরও পৃষ্ঠপোষক,
তাই তখন মহাভারত ও রামায়নের বঙ্গানুবাদ সম্পাদিত হয়েছিল
ইতিহাসে প্রথমবারের মত।
এছাড়া এই বাঙালী সুলতানগণ হিন্দু মানবতাবাদি আন্দোলনকেও সমর্থন দিয়ে গেছেন।
এবং বিভিন্ন উৎসব আয়োজনে এই বাঙালী সুলতানদেরকে দেখি
নিজেদেরকে পরিশুদ্ধ করার জন্য পবিত্র গঙ্গাজল ব্যবহার করতে।
সারকথা হল, এই মুসলিমগণ যদিও বহিরাগত হিসেবে এই অঞ্চলে এসেছিল,
একটি বিদেশী ধর্মের সাথে, দ্বাদশ শতাব্দীতে,
তাঁরা মূলতঃ বাঙালী রাজাতে পরিণত হয়েছিলেন
অনুরক্ত প্রজাদের কাছে তাঁরা এভাবেই পরিচিত ছিলেন।
তো দেখা যাচ্ছে যে এই শক্তি ও ঐক্যের প্রধান উৎসটি
এসেছে বাংলার এই ধর্ম সমন্বয়ের ইতিহাস থেকে।
তাই ১৯০৫ সালে ব্রিটিশরা যখন বাংলাকে দুই ভাগ করতে চেয়েছিল,
ইতিহাসে প্রথমবারের মত, ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে,
খেয়াল করবেন, তখন রবী ঠাকুরের মত লোকেরাও ঐক্যের পক্ষে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন
- ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক ঐক্যের পক্ষে।
এবং জানেন নিশ্চই, এই পরিকল্পনা সম্পর্কে জানার পরে তিনি কি করেছিলেন?
তখন তিনি সেই গানটি লিখেছিলেন, ৬৫ বছর পরে যেটি হবে
বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত, "আমার সোনার বাংলা"।
কিভাবে আমাদেরকে বিভক্ত করবেন?
এবং তিনি রাস্তায় নেমে গেলেন এবং রাখি বাঁধলেন,
যেটি হিন্দু সমাজে আত্মীয়তা ও ভ্রাতৃত্বের চিহ্ন হিসাবে পরিগনিত,
রাস্তায় দেখা প্রতিটি মুসলমানের হাতে।
এবং তারপর চল্লিশের দশকে যখন ভারত বিভক্ত হল,
দেখতে পেলাম বাংলা সংস্কৃতির অস্তিত্বের প্রতি এক হুমকি
আবির্ভূত হল বাংলা ভাষাকে উর্দু দিয়ে প্রতিস্থাপন করার মাধ্যমে।
এবং এমনকি বাংলা বর্ণমালাকে কালক্রমে আরবী বর্ণমালা দিয়ে প্রতিস্থাপনের প্রস্তাব করা হয়।
এবং সেখান থেকেই গণজাগরণের সূত্রপাত,
বাঙালীরা সহসা উপলদ্ধি করতে শুরু করলো
যে পুরো ব্যাপারটির উদ্ভব হয়েছে একটি সংকীর্ণ ধর্মীয় পরিচয় থেকে।
এটি ছিল বাংলা সংস্কৃতির অস্তিত্বের প্রতি এক হুমকি।
তাই এই সময়টাতেই ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হতে দেখি।
এবং এই ভাষা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা স্থপতি ছিলেন মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ,
যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান নিয়েছিলেন
এবং বাংলা ভাষার প্রাচীন ও অভূতপূর্ব উৎপত্তি কে চিহ্নিত করেন
যুগ যুগ ধরে চলে আসা হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম ও খ্রিস্টান ধর্মের সমবেত প্রক্রিয়া হিসাবে।
এবং একই চেতনায়, কাজী নজরুল ইসলাম
বাংলার ঐক্যের গান গেয়ে গেছেন -
"গাহি সাম্যের গান,
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে
সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্লিম-ক্রীশ্চান।"
এবং সারা বাংলা জুড়ে এই ধরনের পোষ্টার দেখেছি
সেই বৈপ্লবিক সংগ্রামের দিন গুলিতে,
আরও একবার, বাংলার শক্তি আর ঐক্য অনুপ্রানিত হয়েছিল
এই অসাধারন বহুমাত্রিকতার ইতিহাস থেকে।
তাই শেষপর্যন্ত ১৯৭১ এ যখন আমাদের মুক্তি অর্জিত হল
- অবশ্যই তা ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকে,
অবশ্যই তা ছিল রাজনৈতিক বৈষম্য থেকে,
কিন্তু সর্বোপরি এটি ছিল ২৫০০ বছরের বহুতাত্বিক দর্শনের ইতিহাসের চরমতম প্রকাশ
যা এতদিন শুধু চিৎকার করে কেঁদেছে,
যা আর মোটেও উপেক্ষিত হতে চায়নি।
আর এখন, আরেকবার, আমাদের নিয়তির আমরাই নিয়ন্তা।
আর যখন প্রতিবেশীর সাথে বন্ধুসুলভ হওয়াকে উত্তম নীতি, উত্তম ন্যায়সঙ্গত নীতি হিসাবে গন্য করা হয়,
এটি একটি ভাল বানিজ্য ও বটে,
বিশেষ করে যখন আমাদের চারপাশের ক্রমবর্ধমান সুযোগ-সুবিধার কথা বিবেচনা করবেন
- নতুন এশীয় শতাব্দির প্রেক্ষাপটে।
যেমন, আমাদের তিন দিক দিয়ে পরিবেষ্টন করা ভারত
এবং তাঁদের দ্রুতগতিতে উত্থানের কথা বলা যায়।
দেখুন আমাদের উত্তর ও পূর্ব দিকে অবস্থিত চীন
- বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি,
আর দক্ষিনে আছে বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর -
এই ভারত মহাসাগর কিন্তু বিশ্বের বৃহত্তম আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল।
এবং এই সুযোগের ব্যাপারটাকেই আরও বিশদ ভাবে বর্ণনা করে রবার্ট কাপলান বলেছিলেন
"এই মহাসাগরটি আবারও বিশ্বের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে,
ঠিক যেমনটি ছিল প্রাচীন ও মধ্য যুগে..."
তাহলে কোন অজুহাতে আমরা এই প্রগতিশীল প্রবৃদ্ধিকে বাজিয়ে দেখবো না?
সমাধানটা আমাদের জানা, এবং আমাদের আছে এক প্রগাঢ় ইতিহাস
যা আমাদের পথ চলার দিক নির্দেশনা যোগাতে পারে
এবং আজ আপনি যদি আপনার আশেপাশে তাকান
এবং দারিদ্র্য পরিবেষ্টিত এই ভয়াবহ বাস্তবতা দেখতে পান,
তাহলে এটাও জানবেন যে এই দারিদ্র্য একটি সাম্প্রতিক ঘটনা মাত্র।
দেখুন, ইতিহাস, বাংলার মহান ইতিহাস,
সব সময়েই বাংলাকে বিবৃত করা হয়েছে তার অপরিমেয় সম্পদ,
তার জাঁকজমক, তার সৌন্দর্য্যের বর্ণনার মাধ্যমে।
তাই দয়াকরে এটি নিয়ে ভাবুন, এগিয়ে আসুন,
এবং হয়ে যান এই পরিবর্তনের একজন অগ্রদূত।
এবং আমি এই ছবিটাকে আপনাদের সাথে রেখে দিতে চাই
- আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, এটি বিমানের নতুন কোনও উড়ালপথের প্রস্তাবনা নয়।
এখানে আপনি যা দেখছেন তা আসলে
সেই সব সভ্যতা ও মানুষদেরকে যারা বাংলার সংস্পর্শে এসেছে
তার দীর্ঘ ইতিহাসের পরিক্রমায় এবং আলোড়িত হুয়েছে।
তাই আবার, আপনি যখন এই পরিবর্তনের একজন অগ্রদূত হয়ে বেরিয়ে পড়বেন
একটি অধিক উন্মুক্ত, সার্বজনীন এবং বহির্বিশ্বের সাথে সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশের জন্য,
জানবেন ইতিহাস আমাদের পক্ষেই আছে
কারণ বাংলার ইতিহাস আসলে বহুমাত্রিকতা ও সমৃদ্ধির ইতিহাস
এবং আগামী দিনগুলোরও সেই একই প্রতিশ্রুতি ধারণ না করার কোনও কারণ নেই।
ধন্যবাদ।